কক্সবাজার, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

কিছু কওনের আছে ক-ন! : আলমগীর মাহমুদ

কিছু কওনের আছে ক-ন!
আলমগীর মাহমুদ

তওসিফ মাহমুদ। আমার ভাইপো। দূ’ভাই একবোনের সংসারে সে মেজ। চাটগাঁয় বসত। বেড়ে উঠা। ফ্ল্যাটের দেয়ালঘেরায় জীবন। আমাদের সুখ দুখ ছেলেবেলা তাদের অচিন। চেনানোর সুযোগও নেই, বদলে।

ঈদ কোরবানিতে কক্সবাজার বিডি আর ক্যাম্প বাসায় আসে। এটিকেই তারা বাবার বাড়ি বলে চেনে, তবে এটুকুনও জানে তাদের বাবারা দূ’ভাই একবোন উখিয়া থেকে এসে এখানে বসত গড়ে।

উখিয়া, রত্নাপালং খোন্দকার পাড়ায় তাদের বংশধর , ভালুকিয়া পূর্বপুরুষের খামার বাড়িতে বাবারা জন্মেছে আবছা আবছা জানে। যাতায়ত হয়েছে কালেভদ্রে একবার কি, দূ’বার, তাও ছোট থাকতে।

তাদের জীবনের রোডমডেল বাবারা। তবে শিক্ষা র্চ্চায়, অর্জনে,ধারনে –এই ভাবনা উদ্রেকটাও একধরনের কূটকৌশলেরই অংশ ছিল আমাদের! সবকিছু যে বইতে শেখানো অসম্ভব!

কূটিলের কদর সমাজে বাঁকাচোখ, পাওন ঘেন্না। ভাল থাকনর লায়ও যে ঘরে বাইরে কূটকৌশল র্চ্চা করন লায় ! কথাটা আমাদের বোধেও ধরা দিয়েছে অনেক হারায়ে ।

শুধু ‘ভাল’ ভাল থাকনর মোক্ষম হাতিয়ার নয়,ভাল থাকনর মারানাস্ত্র ইতিবাচক, পরিস্থিতি বুঝাতে প্রয়োজনে নেতিবাচক, ‘পলেটিক্স পলেটিক্স খেলা ‘! এ খেলায় যে যত পারদর্শী তে তত সফল। বাকীসব কাজেই একসময় ‘? এই (প্রশ্নবোধক) চিহ্নই বইয়ে!

প্রজন্মের বুকে জীবনের নির্মম সত্যগুলো কায়মনে পৌঁছে দিতে খাবার টেবিলকে বানিয়েছি কৌশলী পাঠশালা।

খাবারে একসাথেই বসছি, সহায়ক হয়ে বন্ধু হয়ে আগে হাসি কৌতুকে আমাদের ছেলেবেলার অতীত, দুষ্ঠুমি, মা’র শাসন বলেছি গল্পে গল্পে। বিরিয়ানি, কাচ্ছিতে বন্ধের দিন গুলো পিকনিক পিকনিক পরিবেশ করেছি।

রাজপথের পথিক কেমনে রাজপ্রাসাদ ফিরে পায় ! কি পূঁজি তার! জানাতে বুঝিয়েছি পৃথিবীর পরম সম্পদ ‘আর্শীবাদ’!

সাপের মণির মত এটি রয় মা,বাবা, ওস্তাদ, মুরুব্বি, তালিজোড়ার চালের প্রতিবেশীর চালে, ঘরের কাজের মানুষ , রিকসাওয়ালা, টমটমওয়ালার দিলে, হেঁটে চলা ক্ষুর্ধার্তের খাবারে, হাসপাতালে পড়ে থাকা অসহায় রুগীর আত্মায়, ছেড়া কাপড়ে পথের ধারে পড়ে থাকা দীনহীনের দিলে দিলে। তাঁদের মনের দোয়াই অসাধ্য সাধনের দোহাই!

তওসিফ নবম, মেহনাজ পঞ্চম, শাহরাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ নেবার অপেক্ষায়। ২০১৭ সালে তাঁদের বাবা হজ্বে যাবারদিন গার্মেন্টসের সমস্তকর্মচারীদের কাছে বিদায় নিয়ে আসে বাসায়। বিছানায় শুয়ে তিনভাইবোনেরে ডাকাইয়ে বড় ছেলেকে প্রশ্নরাখে আমার অবর্তমানে তুমি কথা মানবা কার!

চুপরইলে শিখিয়ে কয়… তোর মা’র। কোন বিষয় তোর সাথে না মিললেও তারপরেও তোর মা”র!

অভিশাপ নিবিনা জীবনেও…এরপর পড়ালেখা কোথায়? কোন কোন প্রতিষ্ঠানে তার রোডম্যাপ দিয়ে বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে যায় চিরবিদায়ের মতো। কইয়া যায় সব পরিবারের চলনবলন!

হজ্বের পর খানায়ে কাবায় মকামে ইব্রাহিমের কাছে ফজর নামাজের দ্বিতীয় রাকাতের সিঁজদায় পড়ে তাদের বাবা আর উঠেনি, চিরঘুমে শায়িত হয় আরবের মাটিতে।

বাবার এমন মৃত্যু ছেলেমেয়েগুলোরে বেশ নাড়ায়! কষ্টানুভূতি সহজ করতে তারাও নেয় মিশন। বেলাশেষে ঘুমাতে চায় বাবার সাথে -‘আরবে’ ঠিক বাবার মতো!

তাই বাবার কর্ম ধারনে মরিয়া। দীনহীনের আপন বনতে আসমানের নীচের পুরো পৃথিবীই যে-ন তাদের পাঠশালা!

এবার ঈদ শেষে চাটগাঁ যাওয়া হল না তাদের,বাঁধা লকডাউন। ২৭ তারিখ তওসিফ ফজরের পর দ্বিতীয় লাচায় জেগেই বিছানায় আছে বসে, কি যেন ভাবছে ভাবছে, বেশ মনখারাপ! পরটা ডাল ডিম রেডি খেতে আসেনা, ডাকলেও না।

কৌশলে হাসাতেই সে কয় ” বড়বাবা একা হলেই মনের ভেতর শব্দ করে কে যেন বড় আওয়াজেই কইতে রয় “স্যার আঁই উখিয়াঅলা( উখিয়ার)! আঁই উখিয়াঅলা!

কবিত্ব ছাইরা খাছ কথাখান ক দেহি, নানার বাড়ি গেছিলাম গেলকাল , টারমিনাল থেকে টমটমে বিডিয়ার ক্যাম্পে আসতেই বিজিবি টমটম আটকায়, বেশ ধমকানোর পর যখন চাবিটা জোর করে নিয়ে চলেছে কি করুণ আকূতি ড্রাইভারের!

স্যার আঁই উখিয়াঅলা। স্যার আঁই উখিয়াঅলা (উখিয়ার)উখিয়া চুরিচারি গরিও চালাই ন পারির, চইল পাত বাজার কিছুই নাই, একছেলের জ্বর, ঔষধ কিনতে পারি না,বউয়ের আকূতিতে কক্সবাজার এসছি, বড় শহরর কোনায় কানায় গাড়ি চালাই ঔষধ কিনতাম!

আর অল্প চাউল, কাঁচা মাছ কিনতাম! পাঁচদিনে ঘরে কিছুই নাই স্যার! না পারতেই আসছি স্যার ! নিরুপায় হয়েই আসছি স্যার!

আমরা যারা প্যাসেঞ্জার নীরবে টাকাটা পকেটে গুজে দিয়ে হাঁটা শুরু করি ড্রাইভারের কি কাঁদন! একজন এসেছে নির্দেশে অন্যজন ‘বাঁচাতে’। দূ’জনই ‘বাঁচতে’ চায় শুধু পথ ভিন্ন।

নীরবে হাঁটছি আর হাঁটছি কিছুদূর এসে পিছন ফিরে চাইলাম দেখি টমটমওয়ালা চাবি নিতে পা জড়িয়ে কি কাঁদন! শুধুই আওয়াজ ভেসে আসছে “স্যার ‘আঁই উখিয়াঅলা! স্যার আঁই উখিয়াঅলা”

আমার অন্তর আত্মা কাঁপিয়ে চোখে জল গড়াল! সে যে মরুদেশে উত্তপ্ত মাটিতে শুয়ে থাকা আমার বাবার দেশের মানুষ!

লেখক:
আলমগীর মাহমুদ
বিভাগীয় প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ উখিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ৷
ই-মেইল: alamgir83cox@gmail.com
মোবাইল নং: ০১৭৪০-৫৪৫০৩৫
উখিয়া-কক্সবাজার।

পাঠকের মতামত: